নুরুল ইসলাম নাহিদ
নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৯৪৫ সালের ৫ জুলাই সিলেট জেলায় বিয়ানীবাজার উপজেলার কসবা গ্রামে এক সম্ভ্রান্তমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কসবা প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিয়ানীবাজার পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ হাইস্কুল, সিলেট এমসি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।
তাঁর রয়েছে সুদীর্ঘ সমৃদ্ধ রাজনৈতিক জীবন। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি সকল মহলে স্বীকৃত। নুরুল ইসলাম নাহিদ এমসি কলেজে ছাত্রাবস্থায় ষাটের দশকের সূচনালগ্নে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী হিসেবে তাঁর প্রত্যক্ষ সংগ্রামী জীবনের সূচনা করেছিলেন। সিলেটে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের প্রথম মিছিল ও আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী এবং সক্রিয় কর্মী ও সংগঠকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। পরবর্তীকালে জাতীয় পর্যায়ে ষাটের দশকের সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষার দাবি ও অধিকার অর্জন এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা, গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলন সংগ্রামের প্রথম সারিতে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন অন্যতম প্রগতিশীল বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।
নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৯৭০ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে তৎকালীন এই বৃহৎ ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদকও ছিলেন। এতিনি বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
১৯৯৩ সালে ভারতে বাবরি মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল তা প্রতিহত করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য শেখ হাসিনাকে আহবায়ক করে দেশের সকল অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল, ছাত্র, শ্রমিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বদলীয় ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা কমিটি’ গঠন করা হয়। সেই কমিটির যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন জনাব নাহিদ।
১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে পার্টি সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে নুরুল ইসলাম নাহিদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক।
আশির দশকে তাঁর লেখা দু’টি বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে একুশের বইমেলায় তাঁর তিনটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য বহু বিষয়ে বিশ্লেষণমূলক কয়েকশ’ নিবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৯৯৬ সালে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা (সিলেট-৬) থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদে তিনি ঐ সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
জনাব নাহিদ ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮-এর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা (সিলেট-৬) থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ৬ জানুয়ারি, ২০০৯ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন।
ডঃ তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধূরী
সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান ডঃ তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধূরী, বীর বিক্রম ১৯৪৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যয়ন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগদান করেন।
ডঃ তৌফিক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন।১৯৭১ সালে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে মহকুমা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । ১৭ই এপ্রিল, ১৯৭১ এ বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন। তাঁর বীরত্বের জন্য তিনি বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন ।
স্বাধীনতাত্তোর তিনি সিভিল সার্ভিসে প্রত্যাবর্তন করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তিনি উচ্চশিক্ষার্থে যুক্তরাজ্য গমন করেন।এবং হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৮৩ সালে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়,বিদ্যুৎ,জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়,পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রায় এক যুগ ধরে সচিব পদে কর্মরত ছিলেন।
২০০২ সালে সরকারী চাকুরী হতে অবসর গ্রহণের পর তিনি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৭ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক গ্রোথ সেন্টারে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জানুয়ারী'২০০৯ এ তিনি বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। বিখ্যাত জার্নালে তাঁর আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে এবং তিনি বহু গ্রন্থের প্রণেতা।
গোবিন্দচন্দ্র দেব (১৯০৭-১৯৭১)
প্রকৃত নাম গোবিন্দচন্দ দেবপুরকায়স্থ। জন্ম বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা গ্রামে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রম্নয়ারি। ১৯২৯ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে অনার্সসহ বি.এ. এবং ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ. পাস করেন। ১৯৪৪ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগদান। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘Idealism and progress’ (১৯৫২), `Idealism : A new Defence and A new Application’ (১৯৫৮), ‘আমার জীবন দর্শন’ (১৯৬০), `Aspirations of the common man’ (১৯৬৩) `The philosophy of Vivekananda and Future of Man’ (১৯৬৩) ‘তত্ত্ববিদ্যাসার’ (১৯৬৭) এবং `Buddha : The Humanist’(১৯৬৯)। গোবিন্দচন্দ্র দেব বিশিষ্ট দার্শনিক হিসেবে দেশে বিদেশে খ্যাতিমান ছিলেন।
১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারী সিলেট জেলার বিয়ানীবাজারে উপজেলার লাউতা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দেবের পূর্বপুরুষ ছিলেন ভারতের গুজরাটের বাসিন্দা এবং কুলীন ব্রাহ্মণ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় উত্থান পতনের কারনে তার জনৈক পূর্বপুরুষ পঞ্চম শতকে গুজরাটের আদিনিবাস ত্যাগ করে সিলেটের চলে আসেন এবং স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন।
দেব ১৯২৯ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে বি. এ (সম্মান) এবং ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম. এ ডিগ্রি লাভ করে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুকাল দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনা করে তিনি ১৫৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন।
দেবের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট নয়টি। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে: আইডিয়ালিজম এ্যান্ড প্রগ্রেস(১৯৫২), এ নিউ ডিফেন্স এন্ড এ নিউ এ্যাপলিকেশন(১৯৫৮), আমার জীবনদর্শন(১৯৬৭), এ্যাসপিরেশন অব দি কমন ম্যান(১৯৬৩), দি ফিলোসপি অব বিবেকানন্দ আ্যান্ড দি ফিউচার অব দি ম্যান(১৯৬৩), তত্ববিদ্যাসাগর(১৯৬৬), বুদ্ধ: দি হিউম্যানিস্ট(১৯৬৯)। এই গ্রন্থসমূহ তার জীবিতকালেই প্রকাশিত হয়। দি প্যারাবুলাস অব দি ইস্ট(১৯৮৪) এন্ড মাই আমেরিকান এক্সপিরিয়েন্স(১৯৯৩) নামক গ্রন্থ দুইটি তার মরণোত্তর প্রকাশনা। এছাড়া দেশি বিদেশি ইংরেজি ও বাংলায় দেবের প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
দর্শনে বিশিষ্ট অবদানের জন্য পূর্ববংগ সারস্বত সমাজ ১৯৬৭ সালে দেবকে সম্মানসূচক 'দর্শন সাগর' উপাধিতে ভুষিত করে। একই বছরে তার মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য আমেরিকায় 'দি গোবিন্দ ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড' প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে গোবিন্দদেব দর্শন গবেষনা কেন্দ্র চালু করা হয়। ১৯৮৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর ' একুশে প্রদক' প্রদাস করে।
মানব কল্যান সাধনায়, সত্য- সুন্দর ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায়, মানুষের মুক্তির লক্ষ্য, সাধারন মানুষের আশা আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য এবং অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন চিরকুমার দেব তার সমস্ত সম্পদ ও অর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের সময় তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পাকিস্তানে নিজ জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও তিনি দেশ ত্যাগ করেন নি; এমনকি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও একাত্নতা ঘোষনা করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের গনকবরে তার মরদেহ সমাহিত করা হয়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস